বিশেষ প্রতিবেদক, আবুল মনসুর আহমেদ :
লন্ডনে এক বাংলাদেশি দম্পতির বিরুদ্ধে ভয়াবহ প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। স্ত্রীকে দিয়ে দেহ ব্যবসা, কন্ট্রাক ম্যারেজ করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ। বাসায় সাবলেট ভাড়া দেয়ার কথা বলে অগ্রিম টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া। বিভিন্ন ডেলিভারি কোম্পানির অ্যাপ ভাড়া দিয়ে পুরো টাকা মেরে দেয়া। বিভিন্ন নারীকে বিবাহ করে লন্ডন নিয়ে যাওয়ার প্রলভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নারীদের পাচার করে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশি এই পরিবারের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতাদের কাছে বহু অভিযোগ পড়লেও। স্ত্রীকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করে হাজার হাজার পাউন্ড। বৃটেনের হেইনল্ট এলাকায় বসবাস করা এই দম্পতির নাম আমির হোসন ওরপে আমির ফকির ও রিমা রহমান। প্রতারক এই দম্পতির বাংলাদেশের বাড়ি শরীয়তপুর সদরের ডোমসার ইউনিয়রের ফকিরকান্দি গ্রামে। আমির বাবা আজিজ ফকিরের চতুর্থ ছেলে। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবারের কেউ তাকে পরিচয় দিচ্ছেনা বলে জানা গেছে। তার মেঝো ভাই ডোমসার বাজার মসজিদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
কমিউনিটির নেতারা বলছেন, এই প্রতারক দম্পতির কারণে বৃটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তারা এই দম্পতিকে বিভিন্নভাবে সংশোধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানালেও কোনও কাজে আসেনি। এসব অভিযোগে এই দম্পতির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ পড়েছে ব্রিটিশ পুলিশ ও বাংলাদেশ হাই কমিশিনে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লন্ডনে কোনও জব করেন না এই দম্পতি। চাকরি না থাকলে দেশটির সরকারের নিয়ম অনুযায়ী বেনিফিক প্রাপ্ত হন বাসিন্দারা। এমন অবস্থায় সরকারকে মিথ্য তথ্য দিয়ে কাউন্সিলের ঘর বরাদ্দ পান তারা। দুই সন্তানসহ দোতলা বাড়ি বরাদ্দ নিয়ে তার একটি রুম ছাড়া বাকি সবকটি রুম ভাড়া দিয়ে দেয় তারা। এক্ষেত্রে একটি রুম দেখিয়ে শতশত মানুষের কাছ থেকে অগ্রিম দুই হাজার পাউন্ড থেকে ৫ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত নিয়ে নেন তারা। পরবর্তীতে বাসায় উঠার সময় হলে আর কারো সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা না করে উল্টো ভয়ভীতি দেখান। যদিও সরকারের বেনিফিনের বাসায় সবলেট ভাড়া দেয়া বেআইনী।
অপরদিকে বৃটেনে ফুড় ডেলিবারী খুবই জনপ্রিয়। এই দম্পতি তাদের নিজেদের নামে বিভিন্ন কোম্পানীর অ্যাপ ওপেন করে মাসে ২৫০ থেকে ৫০০ পাউন্ড করে ভাড়া দেন। এক্ষত্রে ভাড়াটিয়াদের কাজের পুরা অর্থ এই দম্পতির অ্যাকাউন্টে যুক্ত হয়। মাস শেষ হলে ভাড়ার অর্থ রেখে বাকি টাকা ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও কারো টাকা ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করেন। এক্ষেত্রে বিষয়টি যেহেতু আইনসিদ্ধ নয় তাই ভুক্তযোগীরা কোনও প্রতিকারও পাননা।
নিজেরা কোনও জব না করলেও চড়েন দামি গাড়িতে। মূল্যস্ফিতীসহ নানা কারণে যেখানে যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে এই দম্পতি কোনও চাকরি বা ব্যবসা না করলেও প্রতারণার টাকায় ছড়েন দামি বাড়িতে। এছাড়া গাজীপুরে জুরাইন ও শরীয়ত পুরে বহুতল বাড়ি এবং আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের প্রকল্পে জমি রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে নিজের অবস্থান জানানোর চেষ্টায় থাকে এই পরিবারটি।
জানা গেছে, বৃটেনের ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ কাজের অনুমতি নেই। এই কর্মঘণ্টা দিয়ে উচ্চমূল্যের টিউশন ফি পরিশোধ করা কঠিন। এজন্য তাদেরকে ক্যাশ ইন হ্যান্ড জব সহ নানান ভাবে কাজ করতে হচ্ছে। অপরদিকে দেশটির প্রধান শহর লন্ডনে আবাসন সংকট চরমে পৌঁছেছে। ফলে থাকার জন্য বাসা বা রুম ভাড়া না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রুম ভাড়ার কথা বলে বিপুল সংখ্যক মানুষ থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দেন না। এসব লেনদেনের পেছনে কোনও চুক্তিপত্র না থাকায় আইনগত কোনও ব্যবস্থাও নিতে পারেন না ভোক্তিভোগীরা। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশটিতে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা এই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
গত বছরের অক্টোবর সেশনে বাংলাদেশ থেকে পড়াশোনার জন্য যুক্তরাজ্যে আসেন সাবেক একজন বিচারক। তার কাছ থেকে বাসা ভাড়ার কথা বলে দুই হাজার ৪০০ পাউন্ড গ্রহণ করেন। কথা ছিলো থাকার পাশাপাশি খাওয়াও অন্তর্ভূক্ত। তিনি লন্ডনে আসার পর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ রক্ষা করেননি আমির। এক পর্যায়ে নানান চাপের মুখে পাকিস্তানী একজন নাগরিককে তার সাবলেট বাসা থেকে বের করে দিয়ে তাকে বাসায় উঠাতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই বাসায় তার জন্য খাবার রাখতেন না এই দম্পতি। এক পর্যায়ে বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ওই বিচারক।
আমিরের স্ত্রী রিমা রহমান জানান, তাকে দিয়ে আমি অনৈতিক কাজ করাতে বাধ্য করেন। পরপুরুষের সঙ্গে এসব কাজ করতে তিনি অনিহা প্রকাশ করলে তাকে তালাক দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিতেন আমির। এজন্য প্রতিরাতে তার উপর নির্যাতন করতেন। বিষয়টি উল্লেখ করে তার স্ত্রী কমিউনিটির নেতাদের কাছে একাধিকবার আমিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোনও কাজ হয়নি।
এ ছাড়া আমির বাসার একটি রুম লেন্ডনের বিভিন্ন সেক্স ওয়ার্কারদের কাছে প্রতিরাতে ২০০-৫০০ পাউন্ড করে ভাড়া দেন।
আমিরের স্ত্রী রিমা রহমানের কাছ থেকে পাওয়া এক ডকুমেন্টে দেখা গেছে, আমিরের উবারের অ্যাপ থাকলেও সে নিজে কাজ না করে তা অবৈধভাবে দিয়ে দেন। স্ত্রী রিমা রহমান তাকে কাজ করার জন্য চাপ দিলে তিনি উবারকে একটি ম্যাসেজ পাঠান। তাতে তিনি লেখেন, আমার স্ত্রী চাননা আমি আমার গার্ল ফ্রেন্ডেরকে সময় দিই। উবারের একান্ট থাকার কারণেন সে আমাকে নিয়মিত কাজ করতে চাপ দিচ্ছে। যে কারণে আমি আমার গার্স ফ্রেন্ডেরকে সময় দিতে পারিনা। তাই আমার অ্যাপটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’
মামুন রহমান নামে এক বাংলাদেশি জানান, কিছু দিন আগে আমি বাংলাদেশে আসে। তার সেঙ্গ আমার পরিচয় ফেসবুকে। এক পর্যায়ে আমি লন্ডনে যাওয়ার পথ জানতে চাইলে তিনি আমার কাছে তার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আমাকে লন্ডন নিয়ে যাবেন বলে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এজন্য তার মেয়েকে ৫০ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানান। আমি তাতে রাজি হই। তাকে নগদ ২৫ লাখ টাকা পরিশোধ করি। বাকি টাকা বিয়ের পর লন্ডনে গেলে দিবো বলে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তিনি টাকা নিয়ে লন্ডন চলে যাওয়ার পর আর কোনও যোগাযোগ রাখছেন না। আমার কাছে তার মেয়েকেও বিয়ে দিচ্ছেন না। টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না।
যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে যাওয়া নাসির উদ্দিন নামে একজন শিক্ষার্থী বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে আমির হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি যেহেতু কোনও বাসা ভাড়া পাচ্ছিনা তাই তার সহযোগিতা চাইলে তিনি সবধরণের সহযোগিতা করবেন বলে আমাকে জানান। তিনি তার বাসার একটি রুম খালি হবে বলে জানানে আমি সেটি মাসে ৯০০ পাউন্ডে ভাড়া নেই। তিনি আমার কাছ থেকে অগ্রিম তিন মাসের ভাড়া গ্রহণ করেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে আমি লন্ডনে পৌঁছলে তিনি আর আমার ফোন ধরেন না। এক পর্যায়ে আমাকে ফেসবুক থকে ব্লক করে দেন। পরে আমি কমিউনিটির নেতাদের কাছে জানালে তারা এই পরিবারের বিরুদ্ধে আরও বহু অভিযোগের কথা জানান।
শুধু শিক্ষার্থী নয়, একজন গণমাধ্যম কর্মীরও তিন হাজার ৬০০ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছেন তিনি। বাসা ও অ্যাপ ভাড়া দেয়ার কথা বলে টাকা গ্রহণ করে আর তা ফেরত দেননি। এ সংক্রান্ত কথোপকথন আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।
আমির বিয়ে করে লন্ডনে নেয়ার আশ্বাসে বাংলাদেশি এক বিধবা নারীর দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে আমিরের বিরুদ্ধে। মিতু হাসান নামে ওই নারী যখন জানতে পারেন তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিয়েতে রাজি না হয়ে তার টাকা ফেরৎ চাইলে উল্টো ওই নারীকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখান। নিজেকে এক বড় নেতার ঘণিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেন। সরকার পরিবর্তন হলে ওই নারীর বাড়িও দখলের হুমকি দেন তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে আমির হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে বলেন, আমি লন্ডনে কী করবো না করবো সেটা আমার ব্যাপার। এখানে ঘর সংসার করতে হলে কাউকে বিয়ে করা লাগে না। আমার স্ত্রীকে আমি বলে দিয়েছি সে যদি আমার কাছে থাকতে না চায় চলে যেতে পারে। এর পর তিনি ফোন কেটে দেন।